মেঘবালিকার মা
তোমার সাথে বিচ্ছেদের আজ ৩৫ বছর পূর্ণ হলো। তোমার একরোখা জেদ নিয়ে কোনো এক শরতের ভর দুপুর বেলায় ৭ মাসের দুধের বাচ্চাকে ঘরে ঘুম পাড়িয়ে রেখেই কাউকে না বলেই ঘর থেকে বেরিয়েছিলে। সৌন্দর্য্য আর যৌবনকে পুঁজি রেখে নিরুদ্দেশের পথেই হেঁটেছিলে সেদিন। একবারও ভাবো নি দুটো প্রাণীর কথা, একবারও ভাবো নি তোমার জীবনের কথা। অথচ দেখো, এখন বয়স কতো হলো তোমার? রূপ-যৌবন ধরে রাখতে পেরেছো? তোমার মুখের চামড়াটা এখন ঝুলে যায় নি? সবশেষ আমার কাছে যে খবরটা ছিলো তা শুনে চমকে গিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত কোথাও আশ্রয় না পেয়ে সোনাগাছির নিষিদ্ধপল্লীতেই আশ্রয় নিয়েছিলে। অথচ, বিয়ের আগে বলেছিলে, ” তোমার বুকেই আশ্রয় দিও মরণ এর আগ পর্যন্ত। তোমার বুকেই যেনো মাথা রেখে মরতে পারি।” অথচ বিভিন্ন পুরুষের গায়ের গন্ধ নিয়েই পার করলে বাকিটা জীবন। এগুলো নিয়ে আর ভাবি না। কারণ কেউই ভাগ্যকে এড়াতে পারে না। আমরা যা চাই না, তা বেশিরভাগ সময়েই ভর করে।মনের মতো সবকিছুই কি হয়? এতোকিছুর পরেও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে তোমাকে লিখতে বসেছি ডায়রীর পাতায়। তোমার ঠিকানা পেলে হয়তো এটা পাঠিয়ে দিতাম। রুদ্র শহীদুল্লাহ এর মতো আকাশের ঠিকানায় অনিশ্চিত চিঠি তো আর পাঠিয়ে দিতে পারি না ! আমার সময় এবং কলমের দাম আছে ! জীবনের কঠিন বাস্তবতায় আকাশের ঠিকানায় চিঠি ছাড়া যায় না। এতো আবেগ আর কাজ করে না। কিন্তু মনের খোরাক মেটাতে ডায়রীর পাতায় না লিখলে সেগুলো অন্তরের ভাঁজে আটকা পড়ে পাছে কষ্ট পেতে পারি বলেই লিখি। কলম থেকে নি:সৃত কথাগুলো মনে হয় মনের ভিতর থেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে। এগুলো মনকে আর বিষিয়ে তুলতে পারবে না। এজন্যই লিখি।
তোমার রেখে যাওয়া সব কাপড়গুলো ওভাবেই পড়ে আছে আলমারিতে। বেশ কিছু কাপড় ইঁদুর-তেলাপোকা পর্যন্ত খেয়েছে। তবুও ওগুলো ফেলে দিই নি। সবকিছুতেই আমার বড্ড মায়া হয়। কিছুই ফেলতে পারি না। তোমার গয়নার বাক্সও আছে; ওভাবেই পড়ে। মেয়ের বিয়েতেও নতুন করে গয়না বানিয়ে দিয়েছিলাম। তবুও তোমারগুলো অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। তোমাকে তো বলাই হয় নি, তোমার মেয়ে মেঘবালিকা আজ দুই সন্তানের মা। ওরা সবাই সুইজারল্যান্ডে থাকে। বলতে দ্বিধা নেই, অনেক কষ্ট করেই তোমার মেয়েকে বড় করেছি। তুমি চলে যাওয়ার পর বিয়ে করি নি; শুধু মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। ওকে মায়ের অভাব বুঝতে দেই নি। মায়ের মমতা আসলে কেমন হয়; সেটা ও বুঝতে পারে নি। মেঘবালিকা বোঝে নি যে – মা কিভাবে বেনি করে চুল বেঁধে দেয়, কিভাবে চুলে নারকেল তেল মেখে দেয়। এগুলো সবই আমি নিজে করে দিয়েছি। ওকে কোন টিপে মানাবে সেটাও পরে দেখিয়েছি। হাতে কলমে ঋতুচক্র বুঝিয়েছি। ঋতুপরবর্তীকালীন যত্ন ও করণীয় সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছি। বিশ্বাস করো, কোনোভাবেই ওকে মায়ের অভাব বুঝতে দেই নি। ও কোনোদিন জিজ্ঞাসাও করে নি তোমার কথা। হয়তো ও বেশ বোঝে; তাই কোনোদিন এই প্রশ্ন করে নি। আমিও নিজ থেকে কিছুই বলি নি। কি আশ্চর্য, তাই না? পুরো একটা জীবন শেষ হয়ে যাবে তবুও মা-মেয়েকে, মেয়ে-মা কে চিনবে না, জানবে না…..অবাক হই মাঝে মাঝে। বার্ধক্য আমাকে পেয়ে বসেছে। শরীরে অনেক রোগ স্থায়ীভাবেই বসবাস করে। ওদেরকে হয়তো আর তাড়ানো সম্ভব হবে না। মেয়ে মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে জোর করে– ওদের জেনেভার বাড়িতে যেনো বসবাস শুরু করি, নাতি-নাতনিকে সময় দিই। কিন্তু এই মাটি আমাকে ছাড়ে না। এই মাটিতে যে খুব শান্তি পেয়েছি তা কিন্তু নয় ! ঐ যে বললাম, মায়া…..মায়ার বাঁধনে আটকে গেছি।
ইতি
মেঘবালিকার হতভাগ্য বাবা
১৮.০৮.২০১৮